বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ০৯:৩৩ অপরাহ্ন

আমরা নিজেরাই পারি স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় কমাতে

আমরা নিজেরাই পারি স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় কমাতে

ড. আর এম দেবনাথ :

করোনা-পূর্বকালে প্রায়ই স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবার ওপর নানা খবর ছাপা হতো। এসব খবরের এখনো কোনো শেষ নেই। তবু আমি এ খাতের ওপর কিছু লিখিনি। লিখিনি, কারণ স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা শাস্ত্রের আমি কেউ নই। এ ক্ষেত্রে আমার ধারণা খুবই কম। তবে রোগী হিসাবে আমি একজন ভুক্তভোগী। নানা অভিজ্ঞতা এ ক্ষেত্রে আমার সঞ্চিত আছে। বন্ধুরাও প্রায় সবাই বয়স্ক। তাদের কাছ থেকেও নানা কথা শুনি। শুনি তাদের অভিজ্ঞতার কথা। বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু, অপচিকিৎসায় মৃত্যু, ভুল চিকিৎসায় মৃত্যু, ওষুধের অপ্রাপ্তি ও তার দুর্মূল্য ইত্যাদি সম্পর্কে প্রায়ই তাদের সঙ্গে কথা হয়, আর নিজেদের মধ্যে হতাশা প্রকাশ করি। হতাশা প্রকাশ করা ছাড়া আর কী করা যায়, যদি খবরের কাগজের খবরের শিরোনামগুলো হয় হতাশাজনক। যেমন ২২ নভেম্বর প্রকাশিত একটি কাগজের খবরের শিরোনাম হচ্ছে : ‘স্বাস্থ্য ব্যয়ে হিমশিম খাচ্ছে দেশের মানুষ’। আবার একদিন পর অর্থাৎ ২৩ নভেম্বর প্রকাশিত অন্য একটি খবরের শিরোনাম হচ্ছে : ‘শয্যা না পেয়ে মেঝে-বারান্দায় ৫৩ শতাংশ রোগী, বিশেষায়িত হাসপাতালে’। খবরের ভেতরে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না, শিরোনাম পড়লেই স্বাস্থ্য খাতের বর্তমান দৈন্যদশার কথা বোঝা যায়।

প্রথম খবরটিতে বলা হয়েছে, সরকারি গবেষণামতে তিন কোটির বেশি মানুষ প্রয়োজন থাকলেও চিকিৎসাসেবা নেওয়া থেকে বিরত থাকে। স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জন থেকে দেশ বহু দূরে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরটিতে বলা হয়েছে, ৬৮ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ স্বাস্থ্যব্যয় বহন করে নিজে। মোট খরচের ৬৪ শতাংশ ব্যয় হয় ওষুধ ক্রয়ে। কোথায় মানুষ চিকিৎসা নেয়? এ প্রশ্নের জবাবও সরকারি গবেষণায় উঠে এসেছে। গবেষণা মোতাবেক, ১৪ দশমিক ৪১ শতাংশ রোগী সরকারি প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা নেয়। এর দ্বিগুণেরও বেশি মানুষ চিকিৎসা নেয় ওষুধের দোকানে। হাতুড়ে ডাক্তারের কাছ থেকে চিকিৎসা নেয় ২২ দশমিক ৫১ শতাংশ মানুষ। গবেষণায় বলা হচ্ছে, ৬৯ শতাংশ মানুষ চিকিৎসাব্যয় নিজে বহন করতে গিয়ে প্রতিবছর ৮৬ লাখেরও বেশি লোকের আর্থিক অবস্থা খারাপ হচ্ছে। আবার ব্যয়বহুল চিকিৎসার কারণে ১৬ শতাংশ খানা (পরিবার) স্বাস্থ্যসেবা নেওয়া থেকে বিরত থাকে।

উপরে বলা হলো স্বাস্থ্যসেবা নেওয়ার ফলে মানুষের আর্থিক অবস্থা কী হয় এবং কে কোথায় স্বাস্থ্যসেবা বা চিকিৎসা নেয়। মাত্র ১৫ শতাংশ মানুষ সরকারি প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা নেয়। বড় বড় বেসরকারি হাসপাতালের কোনো খবর এ গবেষণায় নেই। তবে খুবই দুঃসংবাদ এই যে, ১৬ শতাংশ খানা টাকার অভাবে স্বাস্থ্যসেবা নিতে অপারগ। এদিকে যে গুটিকয়েক ব্যক্তি সরকারি চিকিৎসা নেয়, তাদের চিকিৎসাক্ষেত্রে কী ঘটে? একটি খবর অনুযায়ী, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও নিচের হাসপাতালগুলোতে ১৮ হাজার ৬১১টি শয্যা আছে। সেখানে রোগী ভর্তির হার মাত্র ৭৮ দশমিক ২৯ শতাংশ। জেলা ও জেনারেল হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা ১০ হাজার ৪৫০। সেখানে ভর্তির হার ১৩৭ দশমিক ০৬ শতাংশ। মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে শয্যা সংখ্যা ১৩ হাজার ৭১৩। সেখানে ভর্তির হার ১৫২ দশমিক ৭৩ শতাংশ। এ পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যাচ্ছে, শয্যার সংখ্যা অপর্যাপ্ত। রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোগী যেতে চায় না। এসব ক্ষেত্রে তথ্য ও পরিসংখ্যান লাগে না, আমরা হাসপাতালগুলোর অবস্থা নিজ চোখে দেখতে পাই। অবস্থা এমন যে, সরকারি হাসপাতালে রোগীর ঠাঁই নেই। মেঝে, বারান্দায় রোগীর অবস্থান। অস্বস্তিকর পরিবেশ। মাত্রাতিরিক্ত রোগী ও অ্যাটেন্ডেন্টের উপস্থিতিতে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হয়। এটা হচ্ছে রোগীর শয্যা পাওয়া সম্পর্কিত খবর। ডাক্তার পাওয়া যায় কিনা, ওষুধ পাওয়া যায় কিনা, নার্স থাকে কিনা, দালালের উৎপাত কেমন- এসব খবর যোগ করলে চিকিৎসাক্ষেত্রের অবস্থা কী তা সহজেই বোধগম্য। আবার সরকারি হাসপাতালে ভর্তির জন্য তদবিরও লাগে।

অন্যদিকে বেসরকারি হাসপাতালের সংখ্যা কম নয়। বড় বড় হাসপাতাল আছে। মাঝারি ও ছোট ছোট হাসপাতাল, নার্সিং হোম আছে। আছে ডায়াগনস্টিক সেন্টার। ডাক্তার পাওয়া যায় সেখানে। বড় বড় ডাক্তার। কিন্তু খরচ মাত্রাতিরিক্ত। মূলত ধনী ব্যক্তিরাই এ চিকিৎসাসেবা নিতে পারে। তবে ধনীরা পারতপক্ষে ওই সেবা নেয় না। তাদের একাংশ যায় ভারতে। বাকিরা সিঙ্গাপুর, ব্যাংককসহ বিভিন্ন উন্নত দেশে। বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যায় মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্তের একাংশ। তাদের বিপদে পড়ে ওই সেবা নিতে হয়। অনেককে ওই চিকিৎসাসেবা নিতে গিয়ে ধারদেনা করতে হয়। সঞ্চয় ভাঙাতে হয়। জমিজমা বিক্রি করতে হয়। মানুষ যেহেতু বাঁচতে চায়, তাই সম্পত্তি ও সঞ্চয়ের বিনিময়েও তারা বেসরকারি হাসপাতালে সেবা নিতে যায়। সেখানেও অনিয়ম-স্বেচ্ছাচারিতার বহু উদাহরণ বিদ্যমান। তবু উপায়ন্তর না দেখে মধ্যবিত্ত বেসরকারি হাসপাতালে যায়। এর অন্যতম প্রধান কারণ, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার মতো অবস্থা নেই।

সরকারি হাসপাতালে পর্যাপ্ত ও আশানুরূপ চিকিৎসাসেবা পাওয়া যায় না; আবার এদিকে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা অত্যন্ত ব্যয়বহুল- এ কথা নতুন করে বলা আজকের লেখার উদ্দেশ্য নয়। তবে পাঠকদের শুধু স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য উপরে ছোট দুটি উদাহরণ তুলে ধরলাম। আসল উদ্দেশ্য অন্য একটি প্রসঙ্গে কয়েকটি বিষয় সবার সামনে তুলে ধরা। বিষয়টি ‘স্বাস্থ্য’ সম্পর্কিত। আমার ধারণা হয়েছে, আমরা ‘স্বাস্থ্য’ বিষয়টিকে সর্বাংশে সরকারের বিষয় করে ফেলছি। আমার ভুলও হতে পারে। তবু মনে হয় আমরা স্বাস্থ্যকে নিজের বিষয় বলে মনে করি না। স্বাস্থ্য, চিকিৎসা দেখভাল করছে সরকার। হ্যাঁ, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাব্যবস্থার ব্যাপারে সরকারের দায়িত্ব অপরিসীম। স্বাস্থ্যব্যবস্থার জন্য, মানুষের রোগের সুচিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত অবকাঠামো গড়ে তোলা সরকারের দায়িত্ব। বস্তুত ভাত, কাপড়, শিক্ষা, আবাসন ও স্বাস্থ্য- এই পাঁচটি মৌলিক চাহিদার ক্ষেত্রে সরকারকে সংবিধানে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সরকার অবশ্যই তার সে দায়িত্ব পালন করবে। এ ব্যাপারে শৈথিল্য, অবহেলা ক্ষমাযোগ্য নয়। বিনা ব্যয়ে অথবা কম দামে স্বাস্থ্যসেবা সবার কাছে পৌঁছে দেওয়া সরকারের দায়িত্ব। এ দায়িত্ব সম্পর্কে আমার কোনো দ্বিমত নেই। এসব ব্যাপারে আমি সম্পূর্ণ একমত।

আমার বক্তব্য অন্য। আমার প্রথম প্রশ্ন, ‘শরীর’ বা ‘স্বাস্থ্য’ কার? আমরা বাঙালিরা স্বাস্থ্য বলতে শরীরকে বুঝি। এ শরীরটা আমার। এ দেহটি আমার। এর রক্ষণাবেক্ষণের প্রাথমিক দায়িত্ব আমার নিজের। কিছুদিন আগে যোগশাস্ত্রের গুরু দক্ষিণ ভারতের যাজ্ঞী বসুদেবের একটা বক্তৃতা শুনছিলাম ইউটিউবে। পদ্মশ্রীপ্রাপ্ত এ যোগগুরু বলছিলেন, স্বাস্থ্যটা আমার, এর দেখভাল করার প্রথম দায়িত্ব আমার নিজের। এই প্রাথমিক দায়িত্বকে কোনোভাবেই সর্বাংশে সরকারের ওপর ছেড়ে দেওয়া যায় না। এ প্রসঙ্গে তিনি বলছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা। সেখানকার শিশুদের নাকি ডজন ডজন টিকা দেওয়া হয়। মায়েরা সেজন্য ক্ষুব্ধ ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। সেখানকার স্বাস্থ্যসেবা বস্তুত সবটাই এক ‘বৃত্তের’ হাতে বন্দি। ডাক্তার, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, হাসপাতাল, ওষুধ কোম্পানি, ওষুধের দোকান এবং বিমা কোম্পানি মিলে গড়ে তুলেছে এক বিশাল স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামো। বিমা কোম্পানির বদৌলতে যেহেতু চিকিৎসাসেবা পর্যন্ত ‘ফ্রি’, তাই সবাই কিছু হলেই ডাক্তারের কাছে গিয়ে হাজির হয়। সর্দি-কাশি হলেই তারা ডাক্তারের কাছে চলে যায়। এর পেছনে সরকার বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে। এ চিকিৎসাসেবার খরচ নিয়ে ‘ডেমোক্রেট’ ও ‘রিপাবলিকানদের’ মধ্যে প্রায়ই নির্বাচনি উত্তাপ দেখা দেয়। কারণ স্বাস্থ্যসেবার বিল প্রচুর। এটা সরকারকে বহন করতে হয়। অবস্থা এমন হয়েছে যে, সরকার ডাক্তার থেকে বিমা কোম্পানির এই যোগসাজশ ভাঙতে পারছে না। অথচ এর ফলাফল আমরা এখন করোনার সময়ে পরিষ্কার উপলব্ধি করতে পারছি। দুনিয়ার সবচেয়ে ধনী দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা বস্তুত ভেঙে পড়েছে। করোনায় লাখ লাখ মার্কিন নাগরিক মৃত্যুবরণ করছে। বলা হচ্ছে, তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক দেশের নাগরিকদের তুলনায় কম। যদি তা না হয় তাহলে দুনিয়ার সবচেয়ে উন্নত দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে করোনা ব্যবস্থাপনা কেন ভেঙে পড়ল? বলা হচ্ছে, এটা সরকারের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতার ফল। অতিরিক্ত ওষুধ গ্রহণ, অপ্রয়োজনীয় ওষুধ গ্রহণ, অতিরিক্ত মদ্যপান ও যথেচ্ছাচার- এসবের ফল হচ্ছে বর্তমান স্বাস্থ্য পরিস্থিতি। এসব মূল্যায়ন কতটুকু সঠিক তার বিচার এ শাস্ত্রের সঙ্গে জড়িতরা করবেন। তবে এ কথা বলতেই হয়- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও উন্নত দেশগুলো স্বাস্থ্যসেবার জন্য সরকারের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল। অথচ স্বাস্থ্য বা শরীরটা নিজের। একটু যত্ন করলেই, একটু নিয়ম মেনে চললেই অনেক রোগ-শোক থেকে মুক্ত থাকা যায়। বিশ্বাস করা হয়, বর্তমান দুনিয়ার অসুখ-বিসুখের মধ্যে ১০-২০ শতাংশ ভাইরাস বা জীবাণুজনিত। এসব ক্ষেত্রে আধুনিক চিকিৎসা শাস্ত্র অবশ্যই কাজের। কিন্তু সব ধরনের অসুখ-বিসুখেই আধুনিক চিকিৎসা কার্যকর ও প্রয়োজনীয়, অতীব প্রয়োজনীয়- একথা কি সত্যি? এসব প্রশ্ন এখন উঠছে। আমরা আধুনিক চিকিৎসা গ্রহণের নামে এমন এক অবস্থায় পৌঁছেছি যে, বর্তমানে বাংলাদেশে যে ওষুধ সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়, তা না হলেও চলে। আমরা কি জানি দেশের বাজারে কোন কোন ওষুধ সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়? এবং এসব ওষুধ বিক্রি করে কোন কোন কোম্পানি দিনের পর দিন শত শত কোটি টাকা মুনাফা করে যাচ্ছে?

চিকিৎসাব্যবস্থা মূলত এখন ওষুধ কোম্পানির হাতে। ওষুধ কোম্পানিই মেডিকেল কলেজের মালিক, হাসপাতালের মালিক। একশ্রেণির ডাক্তার তাদের পোষ্য। ডায়াগনস্টিক সেন্টারও তাদের, তারাই সব ধরনের টেস্টের ব্যবস্থা করে। ওষুধের দোকানও তাদের। এ এক ‘বৃত্ত’বিশিষ্ট ব্যবসা, রমরমা ব্যবসা। এ ব্যবসায় সহযোগিতা করার জন্য, হাসপাতালে রোগী ধরে আনার জন্য রয়েছে দালাল। একটি সাধারণ অসুখও এখন জটিল রোগ। একটি উদাহরণ দেই। আমাদের ওষুধের বাজার মোটামুটি ২০ হাজার কোটি টাকার মতো। এর বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ১৫-১৬ শতাংশ। করোনাকালে এ প্রবৃদ্ধির হার হয়তো আরও বেশি হবে। ওষুধ কোম্পানিগুলোর বিক্রি অনেক বেড়েছে। এ বাজারের ৬০-৭০ শতাংশ মোটামুটি ১০টি বড় কোম্পানির দখলে। মোট ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানির সংখ্যা ২০০-এর অধিক। এদের তৈরি ওষুধের মধ্যে ২০১৮ সালে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে কোন ওষুধটি? অত্যন্ত চিন্তার বিষয় যে, অ্যাসিডিটির ওষুধ ওই বছর সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে। তারপরেই অ্যান্টিবায়োটিকের স্থান। দেখা যায় দোকানগুলোতে হরেদরে অ্যাসিডিটির ওষুধ বিক্রি হয়। দোকানদাররাই ‘প্রেসক্রিপশন’ দেয়। অ্যান্টিবায়োটিকও তাই। হরেদরে তা বিক্রি হয়। বলা হচ্ছে, এ কারণে অ্যান্টিবায়োটিক এখন কাজে আসছে না। কারণে-অকারণে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে এ ওষুধটি তার কার্যকারিতা হারিয়েছে। অ্যাসিডিটির ওষুধ ও অ্যান্টিবায়োটিকের পর সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে ডায়াবেটিসের ইনজেকশন, তারপর হাড়-অস্থিসন্ধির ওষুধ। ক্রমান্বয়ে আছে- বাতের ব্যথার ওষুধ, স্নায়ুতন্ত্রের ওষুধ, জ্বর-ব্যথানাশক ওষুধ, ডায়াবেটিসের ওষুধ এবং অ্যাজমার ওষুধ।

এ তালিকা থেকে কী মনে হয়? ধরা যাক অ্যাসিডিটির কথাই। সামান্য জ্ঞানের অধিকারী মানুষ হিসাবে বুঝি- এটা বদহজমজনিত সমস্যা। এরকম অনেক অসুখ-বিসুখই সামান্য সমস্যা, শারীরিক সমস্যা থেকে সৃষ্ট। শরীরের প্রতি একটু নজর দিলেই বিনা ওষুধে এসব রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। বস্তুত আমাদের অনেক দেশীয় পদ্ধতি আছে। আয়ুর্বেদিক, ইউনানি, কবিরাজি, হোমিওপ্যাথি ইত্যাদি অনেক ব্যবস্থা আছে। আছে দৈনিক ‘যোগ’ করার পদ্ধতি। সকালে ঘুম থেকে ওঠা, দাঁত মাজা, পানি খাওয়া থেকে শুরু করে দুপুরের খাবার, রাতের খাবার, ঘুম ইত্যাদি সব বিষয়ে গ্রামাঞ্চলে কতগুলো নিয়ম অনুসৃত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। এখন সবাই জলের বোতল নিয়ে ঘুরে। একটু পরপর জল পান করা অনেকের অভ্যাস। অথচ পিপাসা পেলে জল পান করলেই হয়। শোয়া-বসার নিয়ম আছে। স্নান/গোসল করার সময় গায়ে সরিষার তেল দেওয়ার রীতি গ্রামাঞ্চলে আমরা ছোট বেলায় দেখেছি। তেতো খাওয়া একটা রীতি। অতিরিক্ত মাছ-মাংস না খাওয়া, শাকসবজি বেশি খাওয়া গ্রামীণ প্রাচীন রীতি। খাওয়ার সময় কিছু খাবার পশু-পাখির জন্য রেখে দেওয়াও একটা রীতি। মেরুদণ্ড সোজা করা বসা একটা রীতি। এ তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করা যায়। এর সঙ্গে যোগ করা যায় ‘যোগ’ ব্যায়াম, যাকে আজকাল এই মেথড, ওই মেথড বলে অভিহিত করা হয়। ‘যোগ’ বলতে অনেকেরই আপত্তি। আজকাল দেওয়া হয় ‘ফিজিওথেরাপি’। সেখানে কিছু ‘রে’ দেওয়া বাদে যা হয়, তা যোগেরই অন্য নাম। এভাবে দেখলে বোঝা যাবে, আমাদের গ্রামীণ সমাজ প্রাচীনকাল থেকেই দৈনন্দিন জীবনযাপনে বেশ কিছু রীতিনীতি অনুসরণ করে এসেছে। আমরা আধুনিক চিকিৎসার কবলে পড়ে এসব ছেড়েছুড়ে ওষুধের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি। ডাক্তারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি।

‘শরীর’ নিজের, এই ‘দেহ’ নিজের। বিষয়-সম্পত্তি, চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতি যেমন আমরা দৃষ্টি দেই, সেই দৃষ্টি যদি দৈনন্দিন ভিত্তিতে আমরা শরীরের প্রতি দেই, তাহলে অনেক রোগ থেকে মুক্ত থাকা যায়। কী খেলে পেটে গ্যাস হয়, অ্যাসিডিটি হয়- এটা তো শরীর জানে। শরীরে কথামতো চলতে আমাদের বাধা কোথায়? দৈনিক একটু ব্যায়াম, যোগ করতে বাধা কোথায়? খাওয়া-দাওয়া শরীরের চাহিদা মোতাবেক করতে বাধা কোথায়? এসব করলে বহুলাংশে নিজের স্বাস্থ্য নিজেই রক্ষা করা যায়। তাই নয় কি? শরীর আমার, তার ‘রক্ষণাবেক্ষণও’ আমার। শরীরকে ভালো রাখার দায়িত্ব সরকারের চেয়ে আমাদের বেশি নয় কি?

লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877